আমি অনেক কিছুই লিখি। অবশ্য লেখার কারন আর কিছুই নয়; সময় কাটানো; আর মাঝেমধ্যে পুরোনো দিনের স্মৃতি নিয়ে জাবর কাটা। মাঝেমধ্যেই বেরিয়ে পড়ি গাড়ি নিয়ে। এদিক ওদিক ঘুরে আসি, আর সময় পেলেই লিখি। অবশ্য রিটায়ারমেন্টের পর অফুরন্ত সময়। যত বয়স বাড়ছে, ততই মানুষ চিনতে পারছি; আর একা থাকার ইচ্ছেটা দিনের পর দিন বেড়েই যাচ্ছে। একটা বিষয় খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছি, "একাকিত্ব" কাউকে ঠকায় না।
আজকাল আমার বয়সের অনেকেই দেখি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, পুজো, ধর্মীয় গুরু ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত। হয়তোবা সময় কাটানো এবং মানসিক প্রশান্তির এটা একটা বড় পথ। জানিনা কোনটা ঠিক, আর কোনটা বেঠিক। তবে ভূতত্ত্ববিদ হওয়ার সুবাদে এবং ভারতের বিভিন্ন পাহাড় পর্বত এবং জঙ্গলাকীর্ণ প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘোরার সুবাদে, সন্মুখীন হয়েছিলাম অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত মানুষের। ফলে তৈরি হয়েছিল এক একটি অদ্ভুত অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতার। আজ লিখতে বসলাম, হিমালয় পর্বতের গাড়োয়াল হিমালয় রেঞ্জের,এক জনশুন্য জঙ্গলের এক গুহায় আমার দেখা, এক তপস্বীর কথা।
সময়টা বিংশ শতাব্দীর আশির দশক। আমি কেন্দ্রীয় সরকারে কর্মরত। বিভিন্ন স্থানে পোস্টিং এবং বিভিন্ন ধরনের কাজে অভিজ্ঞতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে চলছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের জিওলজিক্যাল এবং মাইনিং ফিল্ডে ট্রেনিং। সময়টা ছিল সেই বছরের আগস্ট সেপ্টেম্বর মাস। এককথায় বর্ষাকাল। ওই সময় আমাদের ট্রেনিং চলছিল গাড়োয়াল হিমালয় রেঞ্জে। মেইন ক্যাম্প ছিল হৃষিকেশে। আমি চাকুরী জীবনে অনেক ট্রেনিং প্রোগ্রাম অ্যাটেন্ড করেছি, তারমধ্যে সবচাইতে কষ্টকর এবং বিপদসংকুল ছিল ওই হিমালয়ান জিওলজির ট্রেনিং।
একেই সময়টা বর্ষাকাল; ফলে যখন তখন বৃষ্টি; তার উপরে আমাদের প্রতিদিনের ফিল্ড ট্রাভার্সের চলার পথ ছিল খাড়াই, পিচ্ছিল, জঙ্গলাকীর্ণ ফুট ট্র্যাক এবং অপ্রশস্ত খরস্রোতা হিমালয়ান নালা। হাতে থাকতো জিওলজিক্যাল হ্যামার, কোমরে ব্রুন্টন কম্পাস, পিঠে হ্যাভারস্যাক। হাতের হ্যামার শুধুমাত্র পাথর ভাঙার কাজেই ব্যাবহৃত হতো না; মাঝেমধ্যেই কাজে লাগতো, ঝোপঝাড় ও লতাপাতা পরিস্কার করে এগিয়ে চলার রাস্তা তৈরি করার জন্য। গাড়োয়াল হিমালয় রেঞ্জে ওই ট্রেনিং প্রোগ্রাম অ্যাটেন্ড করার আগে পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল, জোঁক কাঁদামাটি ও জলাশয়ে থাকে। কিন্তু জোঁক যে গাছের উপরেও থাকতে পারে, তা ওই সময়ে দেখেছিলাম।
বর্ষাকাল জন্য সঙ্গে ছাতা নেওয়া অথবা বর্ষাতি পড়ার কোন সুযোগ ছিল না। কারন ওই জঙ্গলাকীর্ণ প্রত্যন্ত পাহাড়ি রাস্তায় সঙ্গে ওইসব থাকলে, আর কিছু হোক না কেন, জিওলজিক্যাল ট্রাভার্স হয় না। ফলে আমাদের মাথায় থাকতো টুপি, গায়ে ফুলহাতা শার্ট এবং দুহাতে গ্লাভস। মাঝেমধ্যেই হাল্কা বৃষ্টি হতো, কিন্তু ওই হাল্কা বৃষ্টিতে, বৃষ্টিতে ভেজার হাত থেকে বাঁচার জন্য গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকলেই, গাছের উপর থেকে সমস্ত জামার উপর নেমে আসতো জোঁকের দল। দৌড়ে যেতাম ফাঁকা জায়গায়। জোকগুলো গাছের কচি আগা ডাল দিয়ে ফেলে দিয়ে, ফাঁকা জায়গা দিয়ে হাঁটা শুরু করতাম। প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন মাস ওইভাবে কাটিয়েছিলাম; কিন্তু অদ্ভুতভাবে আমি অথবা আমার সতীর্থ ট্রেনী জিওলজিস্ট এবং আমাদের সঙ্গে থাকা ফিল্ড কুলিদের মধ্যে কারোরই কোনদিনই কোনোরকম সর্দি, কাশি বা জ্বর হয়নি।
এবার আসি আসল ঘটনায়। সেদিন যথারীতি পনেরো জন ট্রেনী জিওলজিস্ট সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে হেভি ব্রেকফাস্ট পর্ব শেষ করে জীপে উঠে বসলাম। জীপ হোটেল থেকে প্রায় ঘন্টা দেড়েক চলার পর, নামিয়ে দিল সবাইকে। ওখান থেকে শুরু হবে আমাদের সেদিনের ট্রাভার্স। চলবে বিকেল চারটে, সাড়ে চারটে পর্যন্ত। তারপর যেখানে ট্রাভার্স শেষ হবে, সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকা জীপ গুলোতে করে আবার হোটেলে ফেরা। হোটেলে ফিরে হালকা লাঞ্চ, একটু বিশ্রাম তারপর ক্লাসরুম লেকচার ও আলোচনা পর্ব, রাত আটটা, সাড়ে আটটা পর্যন্ত। সম্পূর্ণভাবেই হেক্টিক সিডিউল।
সেদিনের ট্রাভার্স শুরু হয়েছিল সুন্দর আবহাওয়ার মধ্যে। রৌদ্রজ্জ্বল পরিবেশ, হালকা ঠান্ডা, পরিস্কার আকাশ। ওখানকার বিভিন্ন জিওলজিক্যাল সাকসেশন দেখার জন্য একটা নালা সেকশন ধরে খাঁড়াই পথে এগিয়ে চলেছিলাম। হটাৎ মেঘের ঘনঘটা, চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হলো বৃষ্টি। একেই ঘন ঝোঁপঝাড় ও জঙ্গল, তার উপরে পিচ্ছিল, খাঁড়াই এবং কোনমতে পায়ে হেঁটে চলার রাস্তা। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য কোন রকমে এগিয়ে চলার পর, হঠাৎ নজরে এলো পাহাড়ের ঢালে, লতাগুল্মের ঝাঁড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক গুহা। হটাৎ করে নজরে পড়েনা। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য সবাই মিলে ঢুকে পড়লাম ওই আধো আলো, আধো অন্ধকার গুহার মধ্যে। বাইরে থেকে গুহা টিকে যতটা ক্ষুদ্র মনে হয়েছিল, ভেতরে ঢুকে দেখলাম একটি বড়সড় গভীর গুহা। গুহার ভেতর থেকে আসছে এক অনুজ্জ্বল লালচে মায়াবী আলোর দ্যুতি।
গুহায় ঢুকে ঢাল দিয়ে অনেকটা নীচে নামার পর শেষপ্রান্তে সমতল পাথুরে মেঝে। তাতে প্রজ্জ্বলিত রয়েছে ধুনি। ধুনির ঠিক সামনে চোখবুজে, নিশ্চল ভাবে বসে রয়েছেন এক জটাজুটধারী, কৃশকায়, স্তব্ধগিরি, মৌনী তপস্বী। চোখ দুটো বোঁজা, ধ্যানমগ্ন; কিন্তু এক স্বর্গীয় অমল প্রশান্তি ছড়িয়ে রয়েছে, তার সমস্ত মুখমন্ডল জুড়ে।
সংখ্যায় আমরা অনেক ছিলাম; পনেরো জন ট্রেনী জিওলজিস্ট, সাত আট জন ফিল্ড কুলি ও একজন প্রশিক্ষক। ওই দৃশ্য দেখে কিছুক্ষণের জন্য হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম সবাই। ওই রকম পার্বত্য এলাকায় ঘন জঙ্গলের মধ্যে ওইভাবে কেউ বসে থাকতে পারে, এ বিষয়ে কোনো ধারনাই ছিল না। শুধুমাত্র ঘন জঙ্গলই নয়, বুনো জন্তু জানোয়ারের আগমনের আশঙ্কাও থাকে, ওইসব জঙ্গলাকীর্ণ পার্বত্য এলাকায়। পুস্তকের নানান কাহিনী ও গল্পে পড়েছিলাম তপস্বীদের কথা। তারা নাকি ওইরকম পরিবেশে দিনের পর দিন তপস্যা করে। কিন্তু সচক্ষে দেখা সেই প্রথম।
এইভাবে কেটে গিয়েছিল বেশ কিছুক্ষণ। ওখানে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিলাম। প্রায় ঘন্টাখানেক ওইভাবে কেটে যাওয়ার পর, বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। আমাদের ফেরার পালা। ফেরার আগে ওই তপস্বীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টায়, সবাই মিলে "সাধুবাবা, সাধুবাবা" করে ডাকতে শুরু করলাম। কিন্তু ওই জটাজুটধারী যোগীপুরুষ তাঁর ওই ধ্যানমগ্ন অবস্থায় নির্বিকার, নিস্তব্ধ ও নিশ্চল।
হটাৎ গুহা মুখে উপস্থিত হলো আর এক সাধু। পরণে গেরুয়া কাপড়। হাতে গাছের শুকনো ডাল পালা। আমাদের অতজন কে ওখানে দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি করতে দেখে, বোধহয় একটু বিরক্ত হলো। কিন্তু কিছুই না বলে, ধীরকন্ঠে আমাদের গুহা থেকে চলে যেতে বললো।
গুহার ভেতরে সাধুবাবার ওই ভাবে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে থাকার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করাতে উনি বললেন, "উনি তপস্বী। বহুদিন ধরে ওইভাবেই ধ্যানমগ্ন অবস্থায় আছেন ওখানে"। ব্যস, এটুকুই। এসব নিয়ে তখন কিছু ভাবিনি। ভাববার মতো মনটা এবং বোধকরি বয়সটাও, তখন আমার ছিল না। শুধু দর্শন হয়েছে মাত্র। এখন ভাবছি। তাই বোধহয় একাকিত্ব ভালো লাগে।
No comments:
Post a Comment
আপনার মেসেজের জন্য ধন্যবাদ, আপনাদের সকল মেসেজ গুলি আমি দেখি, ব্যাস্ততার জন্য অনেক সময় উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়না, আশা করি সময় করে সবার উত্তর দিবো, ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য।