পরিচালক বিমল রায়ের জন্মদিনে তাঁকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই (১২ জুলাই ১৯০৯)
সমস্ত সন্দেহকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বিমল রায় দেবদাসের পার্বতী বেছেছিলেন সুচিত্রা সেনকে৷
ছবির পিছনের কাহিনি লিখছেন —
রিঙ্কি রায় ভট্টাচার্য(পরিচালক বিমল রায়ের কন্যা)
যে ভদ্রমহিলা তাদের বসার ঘরে দাঁড়িয়ে, তাঁর মধ্যে চোখ ধাঁধাঁনো তারকার কোনও লক্ষণ খুঁজে পাচ্ছিল না কৌতূহলী কিশোরী চোখ৷
যে ভদ্রমহিলা তার মায়ের সঙ্গে কথা বলছেন, না তিনি ঠোঁট রাঙিয়েছেন উজ্জ্বল লাল রঙে, না আছে তাঁর গায়ে কয়েক ভরি গয়না৷ চলচ্চিত্র তারকার যে ছবি চোখে ভাসত মেয়েটার, তার সঙ্গে কোনও মিলই নেই মহিলার৷ হাতে এক গোছা চুড়ি ও আটপৌড়ে শাড়ি জড়ানো মহিলাকে দেখলে মনে হয় কোনো সুখী গৃহবধূ৷ ম্যাডোনার মতো নির্মেঘ মুখ ও গোলগাল শরীর দেখে বরং মেয়েটির মনে হয়েছিল যেন রাফায়েলের ক্যানভাস থেকে নেমে এসেছেন ভদ্রমহিলা৷
JALSA
হঠাত্ ঘরে কেউ চাপাস্বরে বলল ‘এই কি কলকাতার বিখ্যাত অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন? কেমন সাধারণ দেখতে!’
মিসেস সেন নামে অধিক পরিচিত সেই রুপোলি পর্দার নায়িকাকে আমি প্রথম দেখি সেই রাতে যে দিন তিনি আমাদের বাড়িতে এক পারিবারিক নৈশভোজে যোগ দিতে এসেছিলেন৷
পরে জেনেছি তিনি আমাদের পারিবারিক আত্মীয়৷ আমার বাবার বড়দিদি রৌশনারা, আমাদের বড়োপিসিমা, ছিলেন তাঁর শ্বশুর আদিনাথ সেনের প্রথম স্ত্রী৷ তিনি অল্প বয়েসেই মারা যান৷ সুচিত্রার স্বামী দিবানাথ তাঁর দ্বিতীয় বিবাহের সন্তান৷ এই ক্ষীণ পারিবারিক যোগসূত্রেই সুচিত্রা সেন আমার বাবাকে ‘বিমল মামু’ বলে ডাকতেন৷
শুনেছি বাবা নাকি রমা সেনকে সিনেমায় নামতে বারণই করেছিলেন, ‘তুমি আমার ঘরের বউমা, তুমি আবার কেন সিনেমায় নামবে?’
JALSA
অদৃষ্টের কী পরিহাস, সেই বাবাই মীনাকুমারী বা নার্গিসের বদলে ‘দেবদাস’-এ (১৯৫৫) পার্বতী চরিত্রে তাঁকে মুম্বইতে প্রথম ব্রেক দিলেন৷
বাংলা থেকে এক জন অভিনেত্রীকে বাছায় অনেকেই ভুরু কুঁচকেছিলেন৷ আঞ্চলিক ছবিতে তিনি স্টার হতেই পারেন, কিন্ত্ত হিন্দি বক্স অফিসের গল্পটা একদম আলাদা৷ ‘দেবদাস’-এর প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে বাবা সুবিধেজনক অবস্থানে ছিলেন৷
তাঁর কথা না মানার কোনও উপায় ছিল না৷ তা ছাড়া উপযুক্ত অভিনেতা নির্বাচনের অনবদ্য ক্ষমতার জন্য বাবার সুনামও ছিল৷
‘উদয়ের পথে’-র নায়িকা গোপা চরিত্রের জন্য নিউ থেয়েটার্সে প্লে ব্যাকের অডিশান দিতে আসা অচেনা বিনতা বোসকে তিনই আবিষ্কার করেছিলেন৷
অতএব আবিসংবাদী নায়ক দিলীপ কুমারের বিপরীতে স্বল্প পরিচিত বাঙালি তারকা সুচিত্রা সেন নির্বাচিত হলেন৷ তবুও পারো চরিত্রে সুচিত্রা সেন আদৌ মানানসই কি না, এ সন্দেহ অনেকেই প্রকাশ করছিলেন৷ এ সব দোলাচলতার মধ্যেই ফ্লোরে দেবদাসের শ্যুটিং শুরু হল, মুক্তি পেল এবং সকলকে মোহিত-ও করল৷ দেবদাসের জন্য পার্বতীর পরিণামহীন ভালোবাসা অতুলনীয় অভিনয়ে ফুটিয়ে তুলে সুচিত্রা সমালোচকদের স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন৷ তাঁর উচ্চারণের বাংলা টান সত্ত্বেও প্রত্যাখ্যাত প্রেমের শক্তিশালী চরিত্র চিত্রণ সে দুর্বলতা ভুলিয়ে দিয়েছিল৷
JALSA
বিমল রায়ের দেবদাসের মতো খুব কম ছবিই মূল কাহিনির এমন নিখুঁত চলচ্চিত্রায়ণ করেছে৷ শরত্চন্দ্রের প্রতি বাবার ছিল গভীর শ্রদ্ধা৷ ফলত তিনি তাঁর রচনার প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে চেয়েছিলেন৷ প্রেম ও বিশ্বাসঘাতকতার এই গল্পে দু’বার প্রতারিত হয় পার্বতী৷
এক বার দেবদাসের কাপুরুষতায় আর দ্বিতীয়ত এই সমাজের দ্বারা৷ একই সাথে দেবদাস হল এই শ্রেণি/বর্ণ বিভক্ত ভারতীয় সমাজে দুর্ভাগ্য তাড়িত শৈশব প্রেমের ভেঙে যাওয়ার আখ্যান৷
কিন্ত্ত পার্বতী এই সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে দেবদাসকে ভালোবাসার সাহস দেখিয়েছিল৷ নেহাতই কিশোর বয়সে সে ভালোবেসেছিল তাকে৷ বিবাহিত জীবনেও সে দেবদাসকেই ভালোবেসে গিয়েছে৷ জীবনে এমন বহু মহিলারই সন্ধান জানি আমরা যারা তাঁদের ছেলেবেলার প্রেমিককে গোপনে ভালোবেসে যান৷ কিন্ত্ত আমি এমন মহিলা খুব কমই চিনি, বিশেষ করে সে যুগে, যারা নিজের স্বামী ব্যতীত অন্য কোন পুরুষের প্রতি তাদের প্রেম এমন দৃঢ় ভাবে ব্যক্ত করতে পেরেছে৷ যে যুগে পার্বতী এটা করতে পেরেছিল তা ছিল অভাবনীয় রকমের আধুনিক৷
একাধিক বার আমরা পারোকে দেবদাসের প্রতি তার প্রেম স্বীকার করতে দেখি৷ যখন তার সখী মনোরমা তার কাছে জানতে চায় কেমন তার বর, পারো হেসে জানায় - ‘উনিশ কুড়ি বয়েস হবে নিশ্চই৷’ স্পষ্ট ইঙ্গিত দেবদাসের দিকে৷
দুই সখীর কথপোকথনে স্পষ্ট হয় ঠিক কতটা গভীর দেবদাসের প্রতি পারোর প্রণয়, বোঝা যায় মনের গভীরে, কত যত্নে পারো লালন করে এই সম্পর্ক৷ সমগ্র আখ্যানে বারংবার পার্বতী উপেক্ষা করে তার সময়ের সামাজিক বিধিনিষেধ৷
এক গভীর রাতে সে বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে সোজা হাজির হয় দেবদাসের শয়নকক্ষে৷ একাধিক বার আমরা তার কণ্ঠে শুনি এই নিঃশর্ত প্রেমের উচ্চারণ৷ পার্বতীর বিবাহ আমার কাছে যেন নারীর সামাজিক নিয়তির বিরুদ্ধাচরণ করে একটা প্রতিবাদ, এ যেন একটা আত্মহত্যা৷ একজন বয়স্ক, দয়ালু জমিদারের গৃহিণী হয়েও পার্বতী তাঁর স্বামীগৃহে অসুস্থ দেবদাসকে এনে তুলতে পিছপা হন না৷ এই ছিল অসাড় সমাজের প্রতি পারোর জবাব৷ বার বার দেবদাস দেখতে দেখতে আমার মনে হয়েছে আসলে পার্বতী ও সুচিত্রা হূদয়ের ক্ষেত্রে সমানধর্মী, যেন তাদের দু’জনের রয়েছে এক গোপন চুক্তি, তারা শুধু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চায় কেমন করে পিতৃতন্ত্র যুগের পর যুগ মেয়েদের নীরব করে রেখে তাদের শাস্তি দিয়েছে৷ কিন্ত্ত তারা পাশাপাশি এটাও দেখিয়েছে কী ভাবে এই পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে হয়৷ পার্বতী ও সুচিত্রা অভূতপূর্ব বন্ধনে আবদ্ধ একটাই চরিত্র যেন শেষ পর্যন্ত৷
প্রাপ্তবয়স্ক দেবদাস ও পার্বতীর ছোট্টো সাক্ষাত্-দৃশ্যটি নিখুঁত দক্ষতায় ফুটিয়ে তোলেন সুচিত্রা৷ ভীত বিহ্বল পার্বতী তার প্রেমিকের অপেক্ষায় অধীর, ঘরে একটি মাত্র প্রদীপ জ্বলছে৷ প্রদীপের শিখার মতোই কম্পিত তার হূদয়, ক্রমে এগিয়ে আসছে দেবদাসের মাপা পদশব্দ, দূরে কোথাও শাঁখের শব্দ জানান দিল দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে৷
আধো আলোয় দেখা গেল দু’জনকে৷ পর্দায় তাদের ছায়া কাঁপছে৷ বিব্রত নীরব দয়িতার অভিজ্ঞতার সিংহভাগ রয়ে গেল না বলা৷ আমার কাছে এ দৃশ্যটি চরিত্রের ইতিহাসে প্রেম ও কামনার একটি অন্যতম বাঙ্ময় অথচ পরিশীলিত নান্দনিক উপস্থাপন৷ খুবই উচ্চমানের অভিনেতা না হলে এমন নীরব প্রকাশ করে ওঠা অসম্ভব৷ অভিনেতাদের জন্য সংযম ও সূক্ষ্মতার এক নতুন মাপকাঠি স্থাপন করলেন সুচিত্রা৷ ‘দেবদাস’-এ সুচিত্রার অভিনয় দেখা যে কোনও নতুন অভিনয়-প্রয়াসীর কাছে একটা কর্মশালার মতো হতে পারে৷ এ অভিনয় মন দিয়ে দেখলে তাদের পক্ষে শেখা সম্ভব কী ভাবে শব্দ ছাড়াই প্রকাশ করা যায় আবেগ, কী ভাবে বজায় রাখতে হয় নীরবতা৷
কিন্ত্ত সুচিত্রার সেরা অভিনয় তখনও দর্শকের জন্য তোলা রয়েছে৷
সম্পূর্ণ অবিশ্বাসের সঙ্গে পারো দেবদাসের মৃত্যু সংবাদ শোনে৷ গ্রিক ট্রাজেডির মতো ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে দেবদাসের ভীতিপ্রদ শেষ পরিণতি৷
আগের রাতে আচমকাই ঘুম ভেঙে যায় পারোর৷ মশারি-বন্দি পার্বতীর কল্পনা দেবদাসের ডাক শুনতে পায়৷ পর দিন প্রভাতে প্রকৃত মৃত্যু সংবাদটি পাওয়া মাত্র তার ভালোবাসার মানুষটিকে শেষ বারের মতো দেখতে বেগবান স্রোতস্বিনীর মতোই ছুটে যায় সে৷ কত কম বলে প্রকাশ করা যায় কিছু, বিমল রায় ছিলেন সে ব্যাপারে দক্ষ এক শিল্পী৷ কিন্ত্ত দেবদাসের এই দৃশ্যটি এক বিরল উদাহরণ যেখানে তিনি আবেগের এই কুণ্ঠাহীন বিস্ফোরণকে বাধা দেন না, বা বলা ভালো একজন বিরহতাড়িত মহিলা বাধা দিতে দেন না তাঁকে৷
এ দৃশ্যের প্রেরণাই যেন পার্বতীর প্রেম৷ সে-ই যেন বাধ্য করে পরিচালককে, তার আবেগের বাঁধ খুলে দিতে৷ এ দৃশ্যের দর্শক এক অদ্ভুত ক্যাথারটিক অভিঘাতের মুখোমুখি হন যেন৷ গেটের দিকে সুচিত্রার রুদ্ধশ্বাস ছুটে যাওয়া দর্শককে বাধ্য করে তার নিজের দিকে ফিরে তাকাতে৷
JALSA
আমি নিশ্চিত সুচিত্রা সেন শুধু এই দৈবের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো পার্বতী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য জন্মাননি৷ বরং তিনি নিজের মধ্যেই সমাহিত করেছিলেন পার্বতীকে, হয়তো তিনি নিজেই বাস্তব জীবনে ছিলেন একজন পার্বতী৷ তাঁর অহং, তাঁর আত্মমর্যাদা, তাঁর বোধের গরিমা পার্বতী নামের সাহিত্যিক চরিত্রটারই অনুরূপ৷ তিনি নিজেরই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন৷ যেন পার্বতীর সাথে এক গোপন চুক্তি ছিল তাঁর, যে যন্ত্রণা বহন করতে হয় মেয়েদের তাকে ফুটিয়ে তুলবার৷ প্রতিটি দৃশ্যে তাঁর এই নিষ্ঠা তাই এ ছবিকে এমন অমর করে রেখেছে৷
আমি নিজে তাঁর বাংলা ছবি, এমনকী উত্তম-সুচিত্রা জুটির ছবি বিশেষ দেখিনি৷ কিন্ত্ত আমি নিশ্চিত ভারতীয় দর্শকের কাছে পার্বতী আর কেউ নন, শুধুই সুচিত্রা সেন৷ পার্বতী চরিত্রে তাঁর অনবদ্য অভিনয় যমুনা দেবী বা ঐশ্বর্য রাইয়ের রুপোলি পর্দার অন্য পার্বতীদের ম্লান করে দিয়েছে৷
যদিও কোনও সরকারি সম্মানই তাঁর জোটেনি, কিন্ত্ত এ জীবনে যথেষ্ট সম্মান তিনি পেয়েছেন৷ আর হাজার হাজার দর্শকের যে শ্রদ্ধা ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন তাই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্মান৷
লেখিকা ‘দেবদাস’-এর পরিচালক বিমল রায়ের কন্যা।
ওপরের ছবিটি দেবদাস- এর প্রিমিয়ারে তোলা।
No comments:
Post a Comment
আপনার মেসেজের জন্য ধন্যবাদ, আপনাদের সকল মেসেজ গুলি আমি দেখি, ব্যাস্ততার জন্য অনেক সময় উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়না, আশা করি সময় করে সবার উত্তর দিবো, ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য।