কালিদাস ছিলেন ধ্রুপদি সংস্কৃত ভাষার এক বিশিষ্ট কবি ও নাট্যকার। ইংরেজ কবি উইলিয়াম শেক্সপিয়রের মতো দেখা হয় তাকে সংস্কৃত ভাষার সাহিত্যে।.[১] তার কবিতা ও নাটকে হিন্দু পুরান ও দর্শনের প্রভাব আছে। কালিদাস প্রাচীন যুগের ভারতীয় কবি। তিনি সংস্কৃত ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিরূপে পরিচিত। যদিও তাঁর জীবনকাহিনি সম্পর্কে বিশেষ নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। কিংবদন্তি অনুসারে, তিনি প্রথম জীবনে মূর্খ ছিলেন এবং বিদূষী স্ত্রী কর্তৃক অপমানিত হয়ে আত্মহত্যা করতে গেলে দেবী সরস্বতীর বরপ্রাপ্ত হন।
তাঁর সময়কাল নিয়ে দুটি মত প্রচলিত। প্রথম মতে, তিনি খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে বিদ্যমান ছিলেন। তাঁর মালবিকাগ্নিমিত্রম নাটকের নায়ক অগ্নিমিত্রছিলেন শুঙ্গবংশীয় রাজা, যাঁর শাসনকাল ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৫-৪৮ অব্দ। অপর মতে, তাঁর সময়কাল খ্রিস্টীয় চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যে। বিক্রমাদিত্য নামে পরিচিত গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সভাকবি হিসাবেই তাঁর খ্যাতি সমধিক। কালিদাসের বহু রচনায় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজ্য, রাজধানী উজ্জয়িনী ও রাজসভার উল্লেখ পাওয়া যায়। সপ্তম শতাব্দীতে বাণভট্ট রচিত হর্ষচরিত গ্রন্থে কালিদাসের সপ্রশংস উল্লেখ আছে।
কালিদাস মেঘদূতম, কুমারসম্ভবম্, রঘুবংশম, ঋতুসংহার, শৃঙ্গাররসাষ্টক, শৃঙ্গারতিলক, পুষ্পবাণবিলাস নামক কাব্য, নলোদয় ও দ্বাদশ-পুত্তলিকানামে দুটি আখ্যানকাব্য এবং অভিজ্ঞানশকুন্তলম্, বিক্রমোর্বশীয়ম, মালবিকাগ্নিমিত্রম নামে তিনটি নাটক রচনা করেন।
কালিদাসের রচনা অত্যন্ত সুপরিচিত হলেও, তাঁর জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। জানা যায়, তিনি ছিলেন দেবী কালীর (মতান্তরে সরস্বতীর) ভক্ত। একটি কিংবদন্তি অনুসারে, এক রাজকন্যার সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়েছিল। কিন্তু কবি ছিলেন গণ্ডমূর্খ। এজন্য রাজকন্যা তাঁকে অপমান করলে, তিনি নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে যান। তখন তাঁর আরাধ্যা দেবী তাঁকে রক্ষা করেন ও বর দেন। দেবীর বরে তিনি কবিত্বশক্তি অর্জন করেন। পরে রাজা বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভায় তাঁর স্থান হয়। কথিত আছে, রাজা কুমারদাসের রাজত্বকালে সিংহলে এক গণিকার হাতে তিনি নিহত হন।
অবস্থান[সম্পাদনা]
কালিদাস ঠিক কোন অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন, তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। কেউ বলেছেন, তাঁর বাসস্থান ছিল হিমালয়ের কাছে; আবার কেউ বলেছেন উজ্জয়িনী অথবা কলিঙ্গে। এই তিনটি অনুমানের কারণ হল, কুমারসম্ভবম্ গ্রন্থে হিমালয়ের বর্ণনা, মেঘদূত গ্রন্থে প্রকাশিত উজ্জয়িনীর প্রতি তাঁর ভালবাসা এবং রঘুবংশম্ গ্রন্থে বর্ণিত কলিঙ্গ-সম্রাট হেমাঙ্গদের স্তুতিবাদ।
সাহিত্যকর্ম
কালিদাসের রচনাবলি ইংরেজি ভাষায় একাধিকবার অনূদিত হয়েছে। পরে জার্মান ভাষাতেও কালিদাসের রচনাবলি অনূদিত হয়। জার্মানির বিখ্যাত কবি গ্যেটে ও হারডার কালিদাসের রচনার উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন।[২] ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর শিল্পীদেরও কালিদাসের রচনা অনুপ্রেরণা জোগায়। ১৯৬১ সালে ভি শান্তারাম অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ অবলম্বনে তাঁর স্ত্রী চলচ্চিত্রটি তৈরি করেন। আর আর চন্দ্র কালিদাসের জীবনালেখ্য অবলম্বনে ১৯৬৬ সালে তৈরি করেন তামিল চলচ্চিত্র মহাকবি কালিদাস। ১৯৮৩ সালে কন্নড় ভাষায় নির্মিত কবিরত্ন কালিদাস ছবিতে অভিনয় করেন রাজকুমার।[৩] ১৯৬০ সালে তেলেগু ছবি মহাকবি কালিদাস ছবিতে অভিনয় করেছিলেন এ নাগেশ্বর রাও।[৪]
কালিদাস ও বাঙালির উত্তরাধিকার
অমরতার আর এক নাম কালিদাস। তাঁর শুভ আবির্ভাবের ক্ষনটি নিয়ে পণ্ডিত মহলে বিবাদের অন্ত নেই,কিন্তু তাঁর সৃষ্টি সেই ধূসর ইতিহাসকে পেরিয়ে দিব্যি আমাদের কালে চলে এসেছে। একেই বলে কালজয়িতা ।অতীতের অন্ধকারময়তা থেকে বেরিয়ে এসে যে কবিবর ,জ্যোতিষ্ক দীপ্তির ন্যায় সমগ্র কবিমানস কে আলোকিত করেছিলেন,তিনি অবশ্যই কবিপতি কালিদাস। বাল্মীকি বা ব্যাসদেবের মতো না হলেও ভারতবর্ষের অগনিত কবি যে কালিদাসের কাব্যসুধা পান করে মুগ্ধ হয়েছেন এবং তাঁর কাব্যরসে সিঞ্চিত হয়ে নব নব সৃষ্টির প্রেরণা লাভ করেছেন - এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। লৌকিক কাব্য নাটকের জগতে কালিদাস সার্বভৌম সম্রাট। কালিদাসীয় সাহিত্যের এই প্রভাব ভারতীয় কবি ও নাট্যকারদের উপর যথেষ্ট রয়েছে। শুধুমাত্র সংস্কৃত নাট্যকারদের ক্ষেত্রে নয় প্রাকৃত ও নব্যভারতীয় আর্যভাষার সাহিত্যের ওপর ও কালিদাসের প্রভাব লক্ষ করা যায়।তাই কালিদাসের কাব্য সর্বভারতীয় সংস্কার ও বিশিষ্টতার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।
কালিদাস 'ঋতুসংহার','মেঘদূত','রঘুবংশ',ও 'কুমারসম্ভব' -এই চারটি কাব্য এবং 'মালবিকাগ্নিমিত্র','বিক্রমোর্বশীয়' ও 'অভিজ্ঞান শকুন্তলম'-এই তিনখানি বিখ্যাত নাটক রচনা করেন। কালিদাসের এই অমর সৃষ্টি পরবর্তিকালে বাংলা সাহিত্যিকদের বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করেছিল।কালিদাসের প্রেমচেতনা সম্ভোগের সীমা ছাড়িয়ে ত্যাগের আদর্শে পবিত্র রূপ লাভ করেছে। একথা বলা অনুচিত না যে কালিদাসের সাহিত্যের প্রেম পরবর্তি বাংলা সাহিত্যকে সমৃমদ্ধ করেছে।
বৈস্নব পদাবলীর মধুর কাকলীতে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে পূর্ণতা লাভ করেছে। প্রেম ও সৌন্দর্যের কবি কালিদাসের প্রেম ও চেতনার ছায়া বৈষ্ণব সাহিত্যে প্রকাশিত হয়েছে । বৈষ্ণব কবিগণ শ্রীরাধার রূপ বর্ণনায় যে সমস্ত উপমা ব্যবহার করেছেন ,তার মধ্যে কালিদাসের প্রভাব আবিষ্কার করা দুরূহ নয়।কালিদাসের মেঘদূত এর উত্তর মেঘে বিরহিণী প্রিয়ার বর্ণনায় যক্ষ যে উপমার প্রয়োগ করেছেন ,বৈষ্ণব পদের বিরহকথায় রাধার তানব দশা বর্ণনা প্রসঙ্গে তার প্রভাব লক্ষ করা যায়। তাই বলা যায় যে বৈষ্ণব প্রেম কবিতা সংস্কৃত প্রেম কবিতারই সাক্ষাত উত্তরাধিকারী । বাংলার বৈষ্ণব কবিতায় কালিদাসের যক্ষ বিলাপের বিপ্রলম্ভের সুর শ্রুত হয় । মঙ্গলকাব্যের বারমাস্যা বর্ণনায় কালিদাসের রচনায় সাদৃশ্য লক্ষ করা যায় ।আবার প্রকৃতির পাশে দাঁড়িয়ে বাঙালি কবিরা কালিদাসকে স্মরণ করেছেন । তবে একথা অনস্বীকার্য যা প্রাচীন বাংলা কাব্যে প্রকৃতির বহিরঙ্গ চিত্রাঙ্কনে কালিদাসের সঙ্গে সাদৃশ্য বস্তুগত। কালিদাসের রচনার প্রভাব বাংলা সাহিত্যের সমস্ত শাখায় পরিলক্ষিত হয় । তাই কালিদাসকে বাঙালি সাহিত্য সাধকদের উত্তরাধিকারী বললে ভুল হয়না। কালিদাসের রচনার প্রভাব সুদূর অতীতকাল থেকে শুরু করে আধুনিক কালের সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পরিলক্ষিত হয় ।
কালিদাস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ
যারা নিপুণ ভাবে রবীন্দ্র রচনাবলী আলোচনা করেছেন,এবং সংস্কৃত সাহিত্যের প্রতি যাদের পরিচয় অতি ঘনিষ্ঠ, তারা অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের কবি প্রতিভার সাথে কালিদাসের কবি প্রতিভার এক অদ্ভুত সাদৃশ্য লক্ষ্য করে থাকবেন। রবীন্দ্রনাথ আশৈশব সংস্কৃত সাহিত্য অনুশীলন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কবি মানসের গঠনে কালিদাসের সাথে স্বাভাবিক ঐক্য ছিল। ঐ কারণে সংস্কৃত সাহিত্যের কবি বর্গের মধ্যে তিনি কালিদাসের উদ্দেশ্যে অন্তরের
শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ স্বদেশীয় ও বিদেশীয় অন্য একাধিক কবির বন্দনা করেছেন বটে কিন্তু ,সে সমস্তের মধ্যে কেমন যেন একটা তটস্থতা আছে।
কিন্তু কালিদাসের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ যে স্তুতি করেছেন তার মূলে আছে তন্ময়ীভাব বা complete
indentation. এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ,যে বিহারীলাল রবীন্দ্রনাথের শৈশবের কাব্য সাধনার ক্ষেত্রে আদর্শ ছিলেন , তিনি নিজেও কালিদাসের মুগ্ধ ভক্ত। সাহিত্য সমালোচনা মহলে চালু আছে যে রবীন্দ্র রচনার বহু উপাদান কালিদাসের সৃষ্টির থেকে গৃহীত। তবে এ কথা সত্য যে ,রবীন্দ্রনাথ কালিদাসের রচনা থেকে যে সমস্ত উপাদান গ্রহণ করেছেন,তা প্রতিভার দ্বারা আপনার সম্পদ করে তুলেছেন । তাকে বহুগুণ মূল্যবান করে নতুন সৃষ্টী রূপে পাঠককে উপহার দিয়েছেন।কালিদাসের কাব্যের প্রেম ,বিশেষ করে বিরহ , প্রকৃতির রহস্যময়তা প্রভৃতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কাব্যের অনুরূপ ভাব সেখানে অঙ্কিত হয়েছে,সেখেনে এই সকল ভাবের ব্যপকতা ও গভীরতার তারতম্য লক্ষ করা যায়। কালিদাসের কাব্য যা অস্পষ্ট বা Classical
কাব্য সুলভ সাধারণী কৃত ভাব মাত্র, রবীন্দ্রনাথের কাব্যে তা প্রায় ব্যপক , গভীর, সুক্ষ পরিমার্জিত ও ব্যক্তি জীবনের অনুভূতির স্পন্দনে আবেগময় ও প্রাণচঞ্চল। কালিদাসীয় কাব্যের রসে ,রবীন্দ্র কবি চিত্ত কালিদাসেরই চিত্ত বৃত্তির সঙ্গে এমন ভাবে এক হয়ে উঠেছে যে রবীন্দ্রনাথ অসংখ্য স্থানে সেই প্রাচীন কাব্যের আবহাওয়া অবলীলা ক্রমে আপন কাব্যে ঘনিয়ে তুলেছেন।
কালিদাসের সেই কবি খ্যাতি তাঁর সমসাময়িক কবি সমাজের ঈর্ষা বিশদ্গারকে উপেক্ষা করে অম্লান রূপে বিরাজমান। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে কালিদাসের স্থান যেমন সুদৃঢ় , রবীন্দ্রনাথ কে নানা বিদ্রূপ সহ্য করতে হয়েছে । কিন্তু রবীন্দ্র প্রতিভার তীক্ষ্ণ দ্যূতি শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়ে উদ্ভাসিত করেছে। কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন ও আধুনিক ভারতের দুই প্রতিনিধি স্থানীয় সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। দুজনের কবি মানসের মৌলিক গঠন এত সুগভীর অন্তরঙ্গ সূত্রে আবদ্ধ যে কাব্য রসিকগণের নিকট এটি একটি পরম রহস্য বলে মনে হয়। অথচ কোথায় কালিদাসের কাল আর কোথায় বিদিশা, কোথায় সে দশান জনপদ, কোথায় নির্বিন্ধ্যা –শিপ্রা- রেবা – বেত্রবতী , কোথায় সেই উদয়ন কথা কোবিদ গ্রাম বৃদ্ধগণের বিশ্রম্ভোগোষ্ঠী ? আর কোথায় বা ঊনবিংশ শতাব্দীর অপরাধে কোলাহল মুখরিত কলকাতা মহানগরীর প্রান্তশায়ী জোড়াসাঁকো গলির ঠাকুরবাড়ি ? এই রূঢ় বাস্তব পরিবেশেই পারিবারিক গৃহ শিক্ষকের কাছে কালিদাসের কাব্যে রবীন্দ্রনাথের প্রথম দীক্ষা -
“মন্দাকিণী-নির্ঝর- শিকরানাং বোঢ়া মূহু কল্পিত –দেবদারু
যদবায়ুরন্বিষ্ঠমৃগৈঃ কিরাঃ তৈরাসেব্যতে ভিন্ন শিখণ্ডীতবর্হঃ ।।’’
‘কুমারসম্ভব ’ এর এই শ্লোকটি বালক রবীন্দ্রনাথের মনে এক অব্যক্ত বেদনার সঞ্চার করেছিলো।
ডেইলি নিউজ টাইমস বিডি ডটকম (Dailynewstimesbd.com)এর ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন করুন।
1.
↑ R A
Malagi (২০০৫),
"Toward a Terrestrial Divine Comedy: A study of The Winter's
Tale and Shakuntalam", Poonam Trivedi; Dennis
Bartholomeusz, India's
Shakespeare: translation, interpretation, and performance,
University of Delaware Press, পৃষ্ঠা 123, আইএসবিএন 9780874138818
2.
↑ Maurice Winternitz and Subhadra
Jha, History of Indian Literature
No comments:
Post a Comment
আপনার মেসেজের জন্য ধন্যবাদ, আপনাদের সকল মেসেজ গুলি আমি দেখি, ব্যাস্ততার জন্য অনেক সময় উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়না, আশা করি সময় করে সবার উত্তর দিবো, ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য।